চিত্রক
কথায় আছে – নেই কাজ তো খই ভাজ। আমারও সেই দশা। অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীর হাতের এক কাপ চা, সাথে অনুপান হিসাবে চিঁড়ে বাদাম ভাজা খেয়ে মনটা বেশ ফুরফুরে আছে। বেশ আয়েশ করে বিছানায় আধশোয়া হয়ে মহাভারত পড়ছিলাম। একটু ভুল বললাম। বলা উচিত ছিল মহাভারত এর গল্প পড়ছিলাম। ম্যাগি লিচি গ্রাসির লেখা দ্য গ্রেট গোল্ডেন স্যাক্রিফাইস অফ দ্য মহাভারত। এই বইটার কথা আমাকে বলেছিলেন গৌতমদা। গৌতমদার সাথে পরিচয় জামশেদপুরে, মাস কয়েক আগে। কাজের সূত্রে জামশেদপুরে গেছিলাম দিন দুয়েক এর জন্যে। সেই কারনেই গৌতমদার বাড়ি যাওয়া কিছু কাজের ব্যাপারে আলোচনা করতে।
গৌতমদা বোধকরি জামশেদপুর আর টাটা ষ্টীল সম্পর্কে জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। যাই হোক, সকালের কাজের কথার পর রাত্রে আবার গেছিলাম ডিনারের নেমন্তন্নে!! একে বাঙ্গালী, তায় আমি বেজায় পেটুক। সুতরাং সোনায় সোহাগা যাকে বলে। কিনতু খাবার কথাটা কয়েক বছর পর যদিও বা ভুলে যাই, গৌতমদা আর সুশ্বেতাদির সাথে কাটানো ওই কয়েক ঘণ্টা জীবনে সব সময়ই কয়েকটা ঝলমলে উজ্জ্বল সময় হিসাবে মনে থাকবে। তার কারন দুজনের অনাড়ম্বর সাবলীল আন্তরিকতা আর নির্ভেজাল সাদামাটা আড্ডায় অনেক কিছু শেখা। নানান গল্পের মধ্যে মহাভারতও ছিল। তখনই এই বইটার সম্পর্কে জানতে পারি। সেই থেকে ভেবে যাচ্ছি বইটা কিনব। সাধারন বাঙ্গালীর মধ্যবিত্তের নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর গল্পের মধ্যে মনের ইচ্ছা আর ইচ্ছার সাকারতার মধ্যে দূরত্বটা বড় বেশি। কিনতু কিছুদিন আগে বইটা আমার হাতে এসেছে। আমি সব সময় নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি। সেই মুষ্টিমেয় কজনের মধ্যে পড়ি যাদের ইচ্ছা কোন না কোন সময়ে পূর্ণ হয়। আর আমার চারপাশের এবং অনেক দূরে থাকা পরিচিতজনেরা প্রত্যেকে এত ভাল, আন্তরিক ও গুনী, যে বোধকরি খুব কম মানুষের এমন সৌভাগ্য হয়।
দেখুন আর পাঁচটা অকেজো মানুষের মতই আমিও বলতে যাচ্ছিলাম এক কথা, আর বলে যাচ্ছি হাবিজাবি কথাবার্তা। ফিরে আসি যেখানে শুরু করেছিলাম মহাভারত। আজকের পৃথিবীতে মার্কেটিং আর প্রমোশন খুবই জরুরি| যাই কারো না কেন, যদি বিক্রি হলো তা তার কদর আছে| বিক্রি না হলে যত অনন্য দামী জিনিসই হোক না কেন কেউ ফিরেও তাকাবে না| এই মার্কেটিং আর প্রমোশন শুধু কোনো প্রোডাক্টেই সীমাবদ্ধ না, মানুষের জন্যেও তা একই ভাবে প্রযোজ্য| আমাদের রাজনীতিবিদদের দেখুন| কি অসাধারণ ভাবে নিজেদের মার্কেটিং করে| কেউ ৩ মাসেই ৫ বছরের কাজ শেষ করে দিলেন, কেউ বা সারা পৃথিবী ঘুরে ফেললেন শুধু বোঝাতে যে তিনি কত ডাইনামিক, কেউ বা বিশাল পার্ক বানিয়ে ফেললেন তিনি কত সৌন্দর্যপ্রিয় তা বোঝাতে, কেউ চিৎকার করে বলে দিলেন রাজ্য পেলেই সব বিদেশীদের বার করে দেবেন দেশ থেকে| আমার মতো বোকাসোকা মানুষেরা সেই সব দেখে তাদের পুজো করা শুরু করে দিই|
গ্রাসির বইটা পড়তে পড়তে মনে হল যে ভগবানকেও কি এই ক্ষমতালোভী মানুষগুলোর মতো নিজের মার্কেটিং করতে হয় নাকি?? ব্যাসদেব যেন সেই অদেখা অজানা অপরিচিত বিধাতা নামক শক্তিকে সেই ভাবেই প্রতিমূর্ত করেছেন নিজের অজান্তেই। অর্জুনের জন্ম মুহূর্তে দৈববাণী হল যে সেই ছেলে অসাধারন বীর হবেন এবং ইনি শ্রীকৃষ্ণের অংশ। অর্জুন “নর” এবং শ্রীকৃষ্ণ “নারায়ণ”। ওখানেই মনে হয় মহাভারত এক নতুন মোড় নিল ওই ছোট্ট ঘটনাতেই। গীতার বীজ যেন ওখানেই বোনা হল। কাশ্যপ মুনিও তার পরেই এসে কুন্তীকে জানালেন যে তার দাদার ছেলে বসুদেবের অষ্টম ছেলে শ্রীকৃষ্ণকে কংস মারতে পারেনি। সে এক গ্রামে অন্য এক মায়ের কাছে বড় হচ্ছে। ওই ছোট্ট অংশের মধ্যেই বাকি মহাভারতের ভিত্তি তৈরি করে দেওয়া হল।
ছোটবেলা থেকে অর্জুন ছিল আমার কাছে আইডল। যেন বীরতার পরিভাষা অর্জুন। কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে নানান জনের লেখা মহাভারত পড়তে পড়তে, নানান জনের বিশ্লেষণ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে ব্যাসদেব অর্জুনকে বড়সড় পুতুল হিসাবে তৈরি করেছেন। বিধাতার হাতের পুতুল। আর সেই বিধাতা হলেন শ্রীকৃষ্ণ। নারায়ণ তার ইচ্ছা পরিপূর্ণ করার জন্যে অর্জুনকে বেছে নিয়েছেন। তাই তার সব প্রতিদ্বন্দীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। আর সেই সবেরই প্রতিফলন হল একলব্যের অপসারন, খাণ্ডবদাহনের কারনে অগ্নির অর্জুনকে গাণ্ডীব ধনুক আর তুনীর প্রদান, কর্ণের কবচ আর কুণ্ডল সরিয়ে তাকে দুর্বল করে দেওয়া, ঘটতকচের মৃত্যু ও আরও নানান ঘটনাবলী। একাধিকবার শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে আমরা শুনি তিনি একাই সমস্ত ক্ষত্রিয়কে বিনাশ করতে পারেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুনের স্বজনদের প্রতি দুর্বলতার কারনে অর্জুনকে নিজের বিশ্বরূপ দেখান। সমস্ত ঘটনার একটাই প্রতিপাদ্য। তা হল “নারায়নের” ইচ্ছা “নরে”র মাধ্যমে স্বকীয় রূপ দেওয়া।
আরে বাবা, সত্যি যদি এক মুহূর্তে সব ধংস করে দিতে পারো তো খামোকা এত সময় নষ্ট করা কেন বাপু? ভেবে দেখো তো একবার যে যোদ্ধারা মরবেই, তাদের জন্যে কত খরচ করা অকারণ| এত যোদ্ধা, অস্ত্র শস্ত্র, চাকরবাকর, তাদের মাইনে – কম কথা? প্রোডাক্টিভিটি কোন জায়গায় নামিয়ে নিয়ে যাওয়া| এক নিমেষের কাজ এত দিন ধরে করা| এই কস্ট কাটিংয়ের যুগে নির্ঘাত বার করে দিতো কোম্পানি থেকে| যুধিষ্ঠির নেহাতই ভালো মানুষ বলে কিছু বলেনি| আর এথিক্সএর কোনো বালাই নেই? কোন আক্কেলে বাপু জয়দ্রথকে ওই ভাবে ঠকিয়ে মারা? ইন্টিগ্রিটি – এক্কেবারে নেই| নাহলে ঘটোৎকচকে ওই ভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে দেয় কেউ অর্জুনের জীবন বাঁচানোর জন্যে? আমি তো ভগবানের শুধু গিমিক তৈরী করা ছাড়া কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না|
এখানেই মনে প্রশ্ন জাগে যে ঈশ্বরও কি সাধারণ মানুষের মতো লোভী? তারও লোভ নিজের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা মানবসমাজে? তিনিও চান যে লোকে তাকে ভয় করুক, তার পুজা করুক? ব্যাসদেবের এই অসাধারন এবং খুব সম্ভবত বিশ্ব সাহিত্যে অতুলনীয় কাব্যের এই একটা দিক এবং কারন আমি বুঝিনি। ঈশ্বর আছেন কি নেই, এই প্রশ্নের উত্তর কারও জানা আছে কিনা জানি না। কিনতু যদি থেকে থাকেন তাহলে সামান্য প্রতিষ্ঠা পাবার এই অক্লান্ত প্রচেষ্টা কোনোমতেই আত্মস্থ করা যায় না। অন্তত আমি পারিনি।
আপনাদের মধ্যে কেউ যদি এই অর্বাচীনের এই অবান্তর এলোমেলো ভাবনার উত্তর জেনে থাকেন, তো অবশ্যই জানাবেন।